বাজারে ‘মিনিকেট’ নামে যে চাল বিক্রি হয়, সেগুলো কোনোটাই মিনিকেট নয়। কারণ এ নামে কোনো ধান নেই। ভিন্ন ভিন্ন ধানের সরু চালকে বাজারে ‘মিনিকেট’ নাম দিয়ে বিক্রি করেন পরিবেশকরা।

কেননা ‘মিনিকেট’ শব্দটি ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়। আর সেই সুযোগে এক একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। তবে বিষয়টি সরকারের উচ্চমহলে আলোচনা হওয়ার পর তা নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ চাল উৎপাদন ও বিপণন তদারককারী সরকারি দপ্তরগুলো মিনিকেট চালের নামে জালিয়াতি ও প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে ৮ শতাধিক চালকল। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো ইতিমধ্যে একাধিক বৈঠক করে মিনিকেট চাল বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘মিনিকেট ব্যান্ড (নিষিদ্ধ) হবে।’

নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, প্রথম ধাপে মিল মালিক, বিভিন্ন সুপার শপসহ মিনিকেট উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে জড়িতদের চিঠি দেওয়া হবে। চিঠিতে মিনিকেট ব্রান্ডের চাল উৎপাদন ও বাজারে না ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হবে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে মিনিকেট নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হবে সরকারের পক্ষ থেকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীতে মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। জালিয়াতি করে মোটা চালকে রোলার মেশিনে পলিশ করে মিনিকেট নাম দিয়ে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। তাহলে মিনিকেট চালের নামে কী খাচ্ছেন ক্রেতারা, এ প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।

তবে অভিযোগ মানতে নারাজ চালকল মালিক সমিতির নেতারা। আর মিনিকেট প্রতারণা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার বিষয়ে যাকে মূল হোতা হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়, রশিদ অটো রাইস মিলের সেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রশিদও অস্বীকার করছেন প্রতারণার কথা।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) বাজার দর এবং বাজার ঘুরে পাওয়া চালের মূল্য অনুযায়ী, বিআর-২৮ জাতের মোটা চাল খুচরা বাজারে এলাকাভেদে ৪৫-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। পাইকারি বাজারে ও মিলগেটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিআর-২৮ জাতের এক কুইন্টাল অর্থাৎ ১০০ কেজি চালের মূল্য ৩৮৩৩-৪৭৯৩ টাকা। মানভেদে কেজিপ্রতি পাইকারি দাম পড়ে ৩৮ থেকে ৪৭ টাকা। সেই চাল পরে মিনিকেট বানিয়ে কেজিতে ৩০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করা হয়।

মিনিকেট ফাঁকিবাজি দাবি করে বিশেষজ্ঞ ও সরকারি দপ্তরের পক্ষ থেকে দায়ী করা হচ্ছে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদকে। বলা হচ্ছে, তিনিই প্রথমে মিনিকেট প্রতারণা শুরু করেন এবং একপর্যায়ে ছড়িয়ে দেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে রশিদ বলেন, এই ধান আমাদের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আবিষ্কার করেনি সে কথা সত্য। তবে সব ধান কি তারা আবিষ্কার করতে পেরেছে। এটা (মিনিকেট) প্রথমে আসছে ইন্ডিয়া থেকে। যশোর থেকে প্রথম আবাদ শুরু হয়। এই হচ্ছে মূল কথা।

রশিদের দাবি, ভারত থেকে উপহার হিসেবে এই ধান এসেছিল। দেশে এখন ব্যাপকহারে মিনিকেট ধান উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘একটা জিনিস, যে নামই হোক না কেন তার কোয়ালিটি কেমন, আকৃতি কেমন, আয়তন কেমন সেটি দেখতে হবে। এই জিনিস তো অন্য জিনিসের সঙ্গে মিলালে হবে না।’

মোটা চাল চিকন করার অভিযোগের বিষয়ে চালকল মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, চাল চিকন করা হয় না। তবে ভারত থেকে মোমপলিশ এনে চালটিকে সিল্কি করা হয। চালের উপরে বাদামি আবরণটা তুলে তলে সাদা করা হয়।

এতে চাল কি পুষ্টিগুণ হারায় না, এমন প্রশ্নের জবাবে রশিদ বলেন, পুষ্টিগুণ হারায়। কিন্তু ঝকঝকে চালে ক্রেতার আগ্রহ বেশি। তাই তারা চাল চকচকে করেন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, মিনিকেট নামের কোনো ধান নেই। আর যে ধানের কথা মিলমালিকরা মিনিকেট হিসেবে বলছেন তার উৎপাদন দেশে তেমন একটা হয় না। বাজারে যত মিনিকেট চাল পাওয়া যায় এর এক-চতুর্থাংশ ওই জাতের (চালকল মালিকরা যাকে মিনিকেট ধান বলে) ধানও দেশে উৎপাদিত হয় না।

মিনিকেট এল কোথা থেকে

কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন ‘শতাব্দী’ ধানের বীজ বিতরণ করে। ২৫ কেজি ওই ধানের বীজের সাথে ৫ কেজি কিটনাশকসহ একটি মিনিপ্যাকেট দেয়া হয়। যাকে ‘মিনি কিটস’ বলা হতো। ‘মিনি প্যাকেট’ বা ‘মিনি কিটস’ থেকেই শেষমেশ মিনিকেট নামটি দাঁড়ায়।